রকিবুজ্জামান রকি: বেহাল দশায় রাজশাহী সুগার মিল, উদাসীন কর্তৃপক্ষ! ছয় মাস যাবৎ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ, চাষীরাও পাচ্ছেন না আখ বিক্রির টাকা। কারখানায় পুরনো মেশিন, আখের অপর্যাপ্ততা, কম উৎপাদনসহ নানান সমস্যায় জর্জরিত রাজশাহী সুগার মিল। এছাড়া টানা লকডাউনে যানবাহন দুষ্প্রাপ্যতা ও অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে ডিলাররাও পারছেন না তাদের বরাদ্দের মালামাল বুঝে নিতে। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশে মাড়াই চালু থাকা ৯টি সুগারমিলের মধ্যে রাজশাহী সুগারমিলের অবস্থান প্রথম! এই সুগারমিলের রয়েছে ৩৫০০ একরেরও বেশি আবাদী জমি। এতে ২০২০ সালে আখ মাড়াই হয়েছে ৬৩,৯৬৪ টন। চিনি উৎপাদনের পরিমাণ ৩৬৪৬.৬০ মেট্রিক টন। ১৩৪৩.৩৭ ভাগ গড় মাড়াই হয়, চিনি আহরণ হয় ৫.৬৮ ভাগ। ২০২০-২১ আখ মাড়াই মৌসুমে আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। তবে অর্জিত হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। জানা গেছে, প্রতি টন চিনির মূল্য ৬৩ হাজার টাকা এবং চিটা গুড়ের টনপ্রতি মূল্য ৩১ হাজার ৭০০ টাকা। বর্তমানে মিলে প্রায় ৩৫০০ টন চিনি মজুত রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ২২ কোটি ৫ লাখ টাকা। এছাড়াও প্রায় ৪০০০ টন চিটা গুড় রয়েছে, যার মূল্য ১২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। রাজশাহী সুগারমিলে কাজ করেন ৬২৮ জন শ্রমিক। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আরও ১০০ জন রয়েছেন। গত বছরের নভেম্বর থেকে টানা ৫ মাস বন্ধ রয়েছে সুগারমিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। এতে চরম অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। অনেকেই এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন তাদের ক্ষোভের কথা। এদিকে রাজশাহী সুগারমিলে আখ বিক্রয় করে বিপাকে পড়েছেন শত শত আখ চাষী। এ বিষয়ে কাটাখালী ইউনিয়নের আখ চাষী ইয়াসিন আলী জানান, গত তিন মাস যাবৎ আমাদের আখ বিক্রয়ের টাকা পাইনি। রাজশাহী সুগারমিলের কাছে শত শত কৃষক টাকা পাবে আখ বিক্রয়ের। প্রতিদিন গিয়েও টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এর মধ্যে চাষীদের কিছু অর্থ পরিশোধ করেছেন। বাকিগুলো শিগগিরই করবেন বলেছেন তিনি। সেই অপেক্ষায় আজও বসে আছি। বেতন-ভাতা না পেয়ে দুঃখ-দুর্দশার কথা এ প্রতিবেদককে জানালেন মিলের ওয়ার্কশপ ফিটার আনিসুর রহমান। তিনি জানান, বেতন ভাতা না পাওয়ায় বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। দোকানদার বাকিতে খাবারও দিচ্ছে না। এক মেয়ে ঢাকার একটি কলেজে অনার্স পড়ে। টাকার অভাবে তাকে ঢাকা থেকে রাজশাহীতেও আনতে পারছি না। প্রচণ্ড দুর্দশার মধ্যে দিন যাচ্ছে আমাদের যা দেখার কেউ নেই। সুগারমিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মনতাজ আলী বলেন, ৫ মাস বেতন-ভাতা সব বন্ধ। মাঝে মাঝেই শ্রমিকরা অফিস ঘেরাও ও প্রতিবাদ করে। তারপরও তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না। বেতন না পাওয়ায় সহকর্মীরা আমাদের (শ্রমিক নেতা) এসে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। আমাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা কর্তৃপক্ষকে বারবার বলেও লাভ হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন,কর্তৃপক্ষ চাইলে এসব সমস্যার সমাধান করতে পারে। মজুত চিটাগুড় ও চিনি বিক্রি করলেই ৩৫ কোটি টাকা এমনিতেই উঠে আসে। তারপরও তা না বিক্রি করে মজুত রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এতে আমাদের যেমন দুর্দশা বাড়ছে, তেমনি শ্রমিক অসন্তোষও বাড়ছে। মিলের সমস্যা বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী সুগারমিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান কবির বলেন, নভেম্বরের দিকে আমি যোগদানের পরই তাদের কয়েকমাসের বেতন-ভাতা দিতে সক্ষম হই। কিন্তু ফান্ডে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় তাদের আর বেতন-ভাতা হয়নি। বর্তমানে আমাদের গোডাউনে ৩৫০০ টন চিনি মজুত রয়েছে। এ মজুত চিনি বিক্রি হওয়ার পর প্রাপ্ত অর্থ থেকেই তাদের বেতন-ভাতা প্রদানসহ চাষীদের পাওনা দিতে পারব। এছাড়া সম্ভব নয়। নানান সমস্যার কথা তুলে ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমাদের প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে, যার সুদ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এদিকে প্রোডাকশন খরচ বাড়ছে, বাড়ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও। শুধু তাই নয় চিনি উৎপাদনে যেখানে খরচ হয় ৮০-৯০ টাকার মতো সেখানে সরকার ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করছে ৬০ টাকা দরে। অন্যদিকে বাজারে বেসরকারি চিনি বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। অথচ তাদের চিনির চেয়ে আমাদের চিনির মান হাজার গুণে ভালো। সমস্যা উত্তরণের বিষয়ে তিনি বলেন,আখের আবাদ বাড়াতে হবে। চাষীদের বিক্রয়লব্ধ আখের অর্থ সঠিক সময়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে আখের মূল্য বৃদ্ধি করতে হবে। এতে কৃষকরা আখ চাষে উদ্বুদ্ধ হবে। ভালো জাতের বীজ তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি আখ মাড়াই মেশিনের মানোন্নয়ন করতে হবে। অন্যথায় আখ শিল্প ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, আমাদের দেশে ৫-৬ টি বেসরকারি চিনি উৎপাদনকারী কোম্পানি রয়েছে। তারা বিদেশ থেকে কাঁচামাল নিয়ে এসে একবারেই কয়েকহাজার টন চিনি উৎপাদন করে ফেলে। দেশীয় সুগারমিলের উন্নয়ন না করলে উৎপাদন ব্যহত হবে এবং তারা পুরোপুরি চিনির বাজার দখল করে নেবে। এতে বর্তমান বাজার মূল্যের চাইতে তিন-চারগুণ বেশি মূল্যে চিনি খেতে হবে। অথচ সেই চিনির গুণগত মান দেশি চিনির চাইতে অনেক নিম্ন।